Skip to main content

বাবার জনকল্যাণ ও পরিবার!

কালী পুজোর এক দুই দিন আগে এক সকালে একে একে অনেকে বাড়িতে আসছে। কেন সেটা না বুঝলেও খুব একটা উৎসাহ নেই এই ব্যাপারে।সম্ভবত তখন আমি প্রথম শ্রেণীতে পড়ি, ফলে আমার এই ছোট বয়সে এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, তাছাড়া এটা আমাদের বাড়ির নিয়মিত ব্যাপার।  কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হল যখন দেখলাম যারা এলেন সকলেই যে যার জুতো নিয়ে ঘরে চলে গেল এবং দিন শেষেও ফিরে গেল না।  অন্যান্যবার বিষয়টা এমন হয় না, ওনারা আসেন, মিটিং করেন, আবার বিকাল বা সন্ধ্যায় ফিরে যান। ওনাদেরই কয়েক জন মিলে বাড়ির পিছনে ইট দিয়ে অস্থায়ী উনুন বানিয়ে রান্না করে সকলের খাবার এর ব্যাবস্থা করলেন, মা তাদের থেকে যথা সম্ভব সাহায্য করছিল। আমাদেরও খাবার ওখানেই হল। খাবার বলতে ভাত-ডাল আর একটা সব্জি। সব মিলে মনে হয় ৪০-৫০ জন মানুষ হবে অথচ এতোটাই শান্তু যে পাশের বাড়ির লোকেরাও বুঝবে না এখানে কেউ আছে।  জানতাম বাবার বন্ধুরা, পার্টির মিটিং এর জন্য এসেছে। ওই শেষ বার ওনাদের দেখেছিলাম । পরে জেনেছি সেই লম্বা মিটিং এ নকশাল পার্টির মধ্যে মতানৈক্যের জন্য পার্টি ভেঙে যায়। আর এও জেনেছিলম, বাবা যে দলটা এতো দিন আদর্শ মনে করে করত সেটাও জাতপাত এর বাইরে নয়।  ফলে যেখানে ভোট বয়কট করে, বিপ্লবের মাধ্যমে বাবা যে নতুন যুগের স্বপ্ন দেখত, সেই দলটাই ছেড়ে দিল।  


এর পর আমাদের পাড়ায় বেশ কিছু ঘটনা ঘটল।  আমি তখন পাড়ার আম্বেদকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি।  সেখানে একটা মূর্তি বসল।  জানলাম ওটা বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকরের মূর্তি, তার পর থেকে সেখানে প্রতিবছর ১৪ই এপ্রিল অনুষ্টান হত। এই সময় বাবা সাহেব নিয়ে আলোচনা চলত বাড়িতে এবং নতুন অনেকের যাতায়াত শুরু হল।  নব্বই এর দশকের শুরুতে একটা নতুন আন্দোলন শুরু হল,  জানলাম পদবীর কারণে বোর্ডের পরীক্ষায় অনেকে ভাল নম্বর দেয়া হচ্ছে না।  এই ব্যবস্থা বদলের দাবিতে বাবা ও পিসতুতু - জ্যাঠাতো দাদারা সহ অনেকে  শিয়ালদহ স্টেশনে অনশনে বসল।  আমরাও তার সমর্থনে নিয়মিত শিয়ালদহে যাওয়া , রেল অবরোধ ইত্যাদির অংশ হয়ে গেলাম।  আন্দোলনে সফলতা এলো সম্ভবত ১১ দিনের অনশনের পরে। পরবর্তীতে এই আন্দোলনের সুফল পিছিয়ে পড়া সমাজের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী পেয়েছে।  

পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষের উন্নতির কাজ শুধুমাত্র একটা আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, দরকার একটা দল।  দরকার ক্ষমতা দখল করা এবং গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার মাধ্যমেই সেটা হবে।  এক সময় যিনি ভোট বয়কট এর ডাক দিত, সে'ই ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য বেছে নিল বাবা সাহেব আম্বেদকর এর তৈরী RPI পার্টিকে। পুনাতে RPI পার্টির মিটিংয়ে আমিও গিয়েছি আরো অনেকের সাথে, মনে আছে বহু লোক হয়েছিল সেই মিটিংয়ে। আবার আরেকটা আন্দোলনের অংশ হিসাবে রেল অবরোধের সময় গুন্ডারা বাবার একটা হাত ভেঙে দেয়।  

মাঝে সাঝে বাবার অফিসে গিয়েছি , কলকাতা ঘোরা ও তারসাথে হয়তো অফিসের কোনো অনুষ্টানে।  বাবার ব্যাংকে অফিসের মূল অংশের বাইরে একটা আলাদা ঘর ছিল।  অফিসে গেলে ওখানেই বসতাম।বাবা অফিসে কাজ করে জানতাম কিন্তু কি কাজ অত বুঝতাম না।অফিসের কাজে বাবাকে প্রায়ই বাইরে যেতে হত , দিল্লি - বোম্বে (মুম্বাই)-মাদ্রাজ (চেন্নাই) সব জায়গায়। হয়ত ১০-১৫ দিন বাদে বাড়ি আসতো , কয়েকদিন থাকত আবার অন্য কাজে বেরিয়ে যেত।  ফলে বাবাকে খুব বেশি  বাড়িতে পেতাম না।  

দলিত আন্দোলন তো ছিলই তারসাথে নতুন সমস্যা শুরু হল ২০০০ সালের কাছাকাছি একটা সময়।  জানলাম নাগরিকত্ত  বিল ও পরে আইন (২০০৪) এসেছে যার জন্য বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে।  এর মধ্যে খবরের মাধ্যমে পুশ - ব্যাক শব্দ জেনে গিয়েছি, বোম্বে ও অন্য জায়গা থেকে মানুষদের ধরে এনে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।  এই নাগরিকত্ত সমস্যা সমাধাদের জন্য ঠাকুরনগর কেন্দ্রীক আন্দোলন শুরু হল।  আবার অনশন ও নতুন আন্দোলন যা পরবর্তী প্রায় ২০ বছর ধরে চলছে। নাগরিকত্ত আন্দোলনের আগে ঠাকুরবাড়ী পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাজনীতিতে কোনো গুরুত্ব পেত না যা পেয়েছে এই আন্দোলনের পরে।  এখানে দুই বার অনশন আন্দোলন হয়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিনিধি পাঠায়।  তারপর এই ঠাকুরবাড়ি থেকে বাংলার মন্ত্রী, MLA , MP ইত্যাদি হয়।  আবার ঠাকুরনগরেই একটা সময় বাবা দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, পরে জানা যায় এই দুষ্কৃতীরাও সেই বাংলাদেশ থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষেরই প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্ম! 

বাবার কর্মক্ষেত্র শুধুমাত্র রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।  সামাজ ও মানুষের জন্য কাজ একই ভাবে করে গিয়েছে। কখনো সেটা বেক্তিগত কেই কখনো সেটা সমষ্টি গত। মনে পরে এক রাত্রে এসে উপস্থিত হওয়া আধা পাগল, হাবাগোবা  এক রামচরণ এর কথা।  সম্ভবত সে বাড়ি ছেড়েছিল বা পথ হারিয়েছিল। তাকে বাবা কলকাতা থেকে বাড়িতে এনে উপস্থিত।  হাবাগোবা গোছের ছেলেটা কয়েকদিন আমাদের খেলার সঙ্গী হয়েছিল। তারপর তার বাবা একটা কাজের ব্যবস্থা করে এক জায়গায়।  একদিন  হটাৎ সে সেখান থেকে পালিয়ে যায় কোনো কারণে। 

আবার মনে আসে পাড়ার এক কাকু তার ছেলের জন্য স্কুলের বই কিনে দিতে না পারার জন্য বাবা তার নতুন বই এর ব্যবস্থা করে।  অবশ্য তখন আমাদের সঙ্গী ছিল মূলত পুরোনো বই যা  অন্যদের থেকে কম দামে  কেনা বা বড় দাদা দিদিদের পুরোনো বই।  আর তার সাথে একটা দুটো নতুন বই যেগুলো সিলেবাস বদলের জন্য কিনতেই হত।  এই নিয়ে কয়েকবার মায়ের সাথে বাবার কাথাকাটিও হয়েছে , যা হওয়া স্বাবাবিক।  

আরেকবার অফিস থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারীর শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরবার কারণ জানতে পারি, নিজের চাদরটা কোনো এক ভিকারিনী বুড়িমাকে দিয়েছে। এমন ছোট ছোট ঘটনা লিখে হয়তো শেষ করা যাবে না।  
  
২০০০ সালে খবরে পড়লাম মুর্শিদাবাদ ও অন্য জেলায় বন্যা শুরু হয়েছে। এর পর  খবরে পড়া বন্যা ধীরে ধীরে আমরা দেখতেও পেলাম।  চারদিক থেকে ধীরে ধীরে  জল বাড়তে বাড়তে একটা সময় আমরাও বন্যার কবলে পড়লাম।  জল দেখে বাবা আমাদের পাঠাল বড় জলের ড্রাম কিনে আনতে ও তার সাথে জিলেটিন যাতে পানীয় জনের অভাব না নয়।  আর তার সাথে বস্তা ভর্তি চাল।  একটা সময় টেন চলাচলও বন্ধ হল।  এমনই এক সময়  বাবা চলে গেল মুর্শিদাবাদ ও ওই দিকে কোথাও ত্রাণ বিতরণের জন্য।  তখন মোবাইল ছিল না।  ফলে কোথায় আছে, কি করছে তার খবর ঠিক ভাবে আমরা জানতে পারতাম না।  হয়ত ৮-১০ দিন বাদে এক সকালে বাবাকে দেখে একটু অবাক হলাম, ট্রেন চলছে না চারিদিকে জল আসল কি ভাবে! জানলাম প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হাবড়ার কাছে পৌঁছেছে এক ট্রাকে, তার পর সেখান থেকে হেটে ও বড়পুলের কাছে (বাড়ি থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে) অনেক জল থাকায় সাঁতরে রাত প্রায় দেড় টা  নাগাদ বাড়ি ফিরেছে। এর কিছুদিন পর আমিও বাবার দলের সাথে গিয়েছিলাম এক জায়গায় নৌকা করে ত্রাণ দিতে।   

তখন আমি ক্লাস ১২ পাস করছি, দাদা পলিটেকনিক মনে হয় ফাইনাল ইয়ারে, দিদির বিয়ে হয়েছে এক বছরের একটু বেশি, ছোট বোন ক্লাস ৮ এ।  বাবার চাকরি করতে গিয়ে সমাজ ও পার্টির কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে  ফলে ব্যাঙ্ক থেকে VRS নিয়ে পুরো সময় রাজনৈতিক দল ও অন্য সামাজিকের কাজ শুরু করল। এই সিদ্ধান্তটা নিশ্চই খুবই কঠিন ছিল কারণ ছেলে-মেয়েরা তখনো পড়াশোনা করছে, বিকল্প আয়  নেই, অন্যদিকে পিছিয়েপড়া সমাজ ও বাংলাদেশ থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষের জন্য কাজ করা, তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করাই প্রাধান্য পায়।  

এর পর ২০০৪ এ নতুন একটা শব্দ জানলাম, সুনামি! ভারতবর্ষ সহ আরো অনেক দেশে ভীষণ ক্ষতি হয়েছে।  খবর এলো আন্দামান এর বহু মানুষ বিচ্ছিন্ন, কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই. খাবার, ওষুধ কিছুই নেই সেখানে।  কিছু ত্রাণ নিয়ে বাবাও উঠে পড়ল আন্দামানগামী জাহাজে। একই জাহাজে ছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘের দল, তারাও চলেছে ত্রাণ দিতে।  পরে শুনেছিলাম আন্দামানের সব সুনামির ফলে  ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে দেখে ভারত সেবাশ্রম সংঘের একজন বাদে বাকি সকলে ফিরে এসেছিল। দলিত আন্দোলণের মূল ভাবধারাই হিন্দুত্ববাদ - ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী। সেই মানসিকতার মানুষ হয়েও , মানুষের কল্যাণের জন্য ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধুর সাথে মিলে মাত্র দুই জনে  ত্রাণ দিয়েছিল ।  মানুষের জন্য কাজ করা প্রাধান্য পাবার জন্য এই প্রতিকুল সময়ে হিন্দুত্ববাদী সংঘঠনের  সাথে মিলে কাজ করতে পিছপা হয়নি ।  আন্দামান থেকে বাড়ি বাবা ফিরেছিল  প্রায় দুইমাস পরে।  

আমরা চার ভাইবোন ছাড়াও বাড়িতে আরো দাদারা ছিল, যাদের কথা অনশনের ঘটনায় বলেছি।  এছাড়াও বাড়িতে নিয়মিত ভাবে অনেকেই আসত।  প্রতিদিন ২-৪ জন থাকা স্বাবাবিক ব্যাপার, এমন একটাও দিন যায়নি যে দিন বাড়িতে পরিবারের বাইরের কেউ নেই।  মৃত্যুঞ্জয় দা , রবিন (নায়েক) কাকু, মানজু কাকু আরো কত মানুষ এর নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাড়িতে।  আর এতো মানুষের জন্য বাড়িতে  মাসে ১০০-১২০ কিলো চাল ছিল একটা স্বাবাবিক প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজনই নয় , এতো মানুষের জন্য রান্না করাও ছিল একটা অসম্ভব কাজ।, যা মাকে একা করতে হত।  বড় দিদি ছিল মায়ের প্রধান সাহায্যকারী। ছোট বেলায়  মা'কে কোনোদিনই বিকাল ৪-৫ টার আগে চান করতে দেখিনি।  আর মায়ের কাজ শেষ করে খেয়ে উঠতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা হয়ে যেত।  মনে পড়ে না কেউ কোনো দিন বাড়িতে এসে না খেয়ে ফিরেছে। বিনা খবরে রাত ১০ ও মানুষ এসে উপস্থিত হত।   বেশিরভাগ দিনই বাড়িতে এক-দুই জনের খাবার বেশি রান্না করা হত ।  যদি অতিথির সংখ্যা বেশি হয় তবে মা কে আবার রান্না করতে হত সেই রাত্রে। আর তখন কিন্তু রান্না হত  কাঠে , কেরোসিনে  বা কয়লায় , গ্যাস এর সুবিধা তখন আসেনি।  আমরা বিরক্ত হতাম, এই ভেবে যে, বাড়িতে ফোন (ল্যান্ডলাইন) আছে তবু  কেন এই মানুষগুলো একটা ফোন করে আসে না, তাহলে তো এই রাত্রি ১১-১২ টায় রান্না করার  প্রয়োজন হয় না। পরের দিন ভোরে মায়ের শুরু হত আবার সকালের রুটিন যা চলত সন্ধ্যা থেকে রাত্রি পর্যন্ত।  

সম্ভবত বাবা তখন আন্দামানে বা অন্য কাজে বাইরে গিয়েছে , বহুদিন হয়ে গিয়েছে কোনো খবর নেই।  মায়ের হাতে পয়সা নেই।  বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ফলে বেতন নেই, পেনশন কিছু  আসতো কিন্তু সেটা অফিসে গিয়ে তুলতে হবে যা বাবা ছাড়া হবে না।  এদিকে চাল ও মুদির দোকানে ইতিমধ্যেই বাকি হয়েছে , মা আরো বাকি করতে পারছে না।  আবার বাড়িতে দুপুরের রান্না হলেও রাতের রান্নার চাল বাড়ন্ত। কি করে কি হবে ভেবে মা আকুল।  এমন সময় সম্ভবত রবিন (নায়েক) কাকু এক ব্যাগ চাল নিয়ে উপস্থিত।  ওনাদের নতুন ধান উঠেছে , যা দিতে সেই সুদূর বাঁকুড়া-পুরুলিয়া থেকে এসেছে! এভাবেই সেই দিন মায়ের চিন্তা লাঘব হল।  

বাবা সরকারি চাকরি করলেও সেই হিসাবে আমরা ভাইবোনরাও সম্ভবত কখনো জোর করে কিছু দাবি করিনি। অবশ্য একটা লিখতে গিয়ে আমার একটা কথা মনে এলো।  তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, দুই কিলোমিটার দূরের স্কুলে হেটে যাই।  ফিরবার সময় অন্যদের সাইকেলের আগে এসব বলে দৌড়ে প্রায়  এক কিলোমিটার আসি।  একদিন কেউ কিছু একটা হয়ত বলেছিল, খারাপ লাগায় দাবি করি একটা সাইকেল চাই। বাড়ি ফিরে চলে আমার অনশন আন্দোলন সাইকেলের দাবিতে। রাত্রে বাবা অফিস থেকে ফিরে পরের দিনই নতুন সাইকেল কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়, এর পর আমার  এই অনশন ভাংগে। বাবার তখন মনে হয় হাজার ৩-৪ টাকা মাহিনা , ফলে  ১২০০-১৩০০ টাকার সাইকেল বাবার পক্ষের তখন কেনা যথেষ্ট সমস্যার ছিল, জানিনা হয়ত ধার করে ম্যানেজ করেছিল।  এর পর আরেকবার, তখন ক্লাস ৮ বা ৯ এ পড়ি।  স্কুলের ছাত্র দের নিয়ে কলকাতার  সায়েন্স সিটি ঘুরতে যাবে। খুবই যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু যাতায়াত ও খাওয়া খরচ বাবদ ৭৫ টাকা লাগবে। হয়ত তখন বাড়ির অবস্থা কিছুটা বুঝতে শিখেছিলাম তাই আর ইচ্ছাটার কথা মা কে জানাই নি।  বাকি ভাই বোন দের অবস্থাও একই ছিল। শুনেছি দিদির কলেজে যেত খালি পকেটে ফলে টিফিনের সময় বন্ধুদের চোখের আড়ালে চলে যেত।     

বাবার কাছে কয়েকবার বকা শুনেছি, মারও খেয়েছি একদুই বার।  কিন্তু সেগুলো ছিল দুস্টুমী  করবার জন্য।  পড়ার ব্যাপারে বাড়িতে বাবার নির্দেশ ছিল, পড়া নিয়ে বকাঝকা যেন না হয়। বিশ্বাস করত দরকারি পড়াশোনা এমনিই সময় আমরা মত করে নেব। পরবর্তী জীবনে অবশ্য বাবার এই বিশ্বাসই সঠিক  হয়েছে, আমরা ভাই বোনরা প্রয়োজন অনুসারে প্রয়োজনীয় জিনিস ঠিকই শিখে নিয়েছি ।

চাকরি ছাড়বার পর বাবা বিকল্প আয়ের জন্য একটা ব্যবসা শুরু করল।  এই কারণে বাড়ি ব্যাঙ্ক এর কাছে বন্ধক রেখে লোন নিয়ে দুটি লরি কেনে।  কিন্তু সেখানে বিশেষ কিছু আয় না হওয়ায় এবং ব্যাবসার প্রয়োজনে বিল্ডার্স এর ব্যবসা করে।  আমি তখন কলেজ ছাত্র।  মাঝে মাঝে এই ব্যাবসার দেখাশোনা করতাম। লরির ক্ষেত্রে ড্রাইভার দের দুর্নীতির ফলে লাভ হচ্ছিল না।  আবার গ্রামের কিছু অসাধু মানুষ বাবার মানসিকতা বুঝে তার সুযোগ নেয়।  বিভিন্ন উপায়ে তারা ধারে জিনিস নেয় কিন্তু ধার শোধ করে না।  ফলে একসময় বিল্ডার্সের দোকানে ৪-৫ লাখ টাকা বাকি হয়ে যায়।  ২০০৪-২০০৫ সাল নাগাদ যা ছিল একটা যথেষ্ট বড় অঙ্ক।  ব্যাংকার লোন শোধ না করতে পেরে বারবার চিঠি আসতে থাকে।  অন্যদিকে বাবা তখন কখনো জনকল্যাণ এর জন্য আন্দামানে আবার কখনো দিল্লি বা বোম্বেতে পার্টির কাজে ব্যাস্ত।  এমন সময় ব্যাঙ্ক বাড়ি দখল নেবার নোটিশ দেয়।  যা মূলত আমার বড় জেঠু ও জামাই বাবু গৌতম (বিশ্বাস) দা'র থেকে টাকা ধার নিয়ে বাঁচানো হয়।  জেঠুর এই ঋণ মনেহয় আর শোধ করে ওঠা হয়নি।  সেই সুযোগও আর নেই কারণ জেঠু - জেঠিমা কেউই আর নেই আর তাদের একমাত্র ছেলে বহু বছর বিদেশের স্থায়ী বাসিন্দা।  অন্যদিকে যে সমস্ত খরিদ্দার ধার নিয়েছিল তারাও কেউ ধার শোধ করেনি।  কিছু সময় বাদে লোকসানের কারণে বিল্ডার্সের দোকান বন্ধ করতে  হয় এবং ব্যাঙ্ক তাদের লোনের টাকায় কেনা লরি গুলো বাজেয়াপ্ত করে। ইতিমধ্যে দাদা একটা চাকরি পেয়েছিল এবং আমি টিউশন করে হাত খরচ জোগাড় শুরু করেছিলাম।  এর এক বছরের মধ্যে আমিও একটা ছোট চাকরি পাই।          

বাবা অধিকাংশ মানুষের  চেয়ে বুদ্ধিমান ও সময় মত সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে।  সেটা রাজনৈতিক বা ব্যাক্তিগত সব সময়ই।  যখনই কোনো প্রতিকূল পরিস্তিতি দেখেছি এই সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে কখনো ভুল হয় নি।  গত বছর জামাইবাবুর করোনার কঠিন পরিস্তিতির সময়ও দেখেছি। কিন্তু যে কোনো সংগঠন বা দল করবার ক্ষেত্রে অনেকে নিয়ে চলতে হয়. সেখানে ভাল - খারাপ - বুদ্ধিমান-বোকা - মাঝারি সকল ধরণের মানুষ থাকে।  তাদের বিচার - বুদ্ধি যেমনই হোক উদ্দেশ্য ও মানসিকতাকে সম্মান জানাতেই হয়।  বিশেষ করে যেখানে সব রাজনৈতিক দল পাইয়ে দেবার রাজনীতি করে , সেখানে কেউ যদি এমন দল ও মানুষের সাথে থেকে যার থেকে সেভাবে পাবার কিছুই নেই।  তাছাড়া এই সব মানুষ গরিব, যাদের প্রায় কিছুই নেই।  ফলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করে যা হয়ত পরিস্থিতির ফলেও হতে পারে।  আবার সকলের বিচার বুদ্ধির ক্ষমতা যাই হোকনা কেন  আত্মসম্মান বোধ সকলেরই থাকে।  ফলে বাবার সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও অন্যরা যদি মতামত জানানোর সুযোগ না পায়, তবে নিজেকে গুরুত্বহীন বোধ করে এবং এর থেকে  একসময় দুরত্ব তৈরী হয়।  আমার মনে হয় এই কারণে বাবার অনেক সহযোদ্ধারা নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল ।  অবশ্য এটা সম্পূর্ণ আমার বেক্তিগত উপলব্ধি।    

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে বাবা চেষ্টা করে গিয়েছে মানুষের জন্য কাজ করতে।  সেটা বাম চিন্তাধারা হোক বা আম্বেদকরবাদ।  উদ্দেশ্য পিছিয়ে পড়া দুঃস্থ ছিন্নমূল মানুষের জন্য কাজ করা।  এই মানসিকতার থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি।  সময়ের সাথে সাথে পদ্ধতি বদল হয়েছে যা কখনো সফলতা এনে দিয়েছে কখনো দেয়নি। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি কখনো হয় নি।  আবার নিজের সুবিধা দেখে  কখনো কোনো অন্যায় এর সাথে আপোষ করেনি।  সোজা পথে হচ্ছে না বলে ঘুরিয়ে কাজ করবার চেষ্টাও করেনি। ফলে আমাদের মতো সমাজে যা অনেক সময়ই সফলতা পায়নি। বাবা একসময় ফুটবলার ছিল।  অনেকবার এই খেলার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, "ফুটবলে গোল দেবার জন্য অনেক সময় বলকে নিচে নামিয়ে এনে কাউন্টার এট্যাক এ যেতে হয়", কিন্তু নিজেই কখনো সফলতা পাবার জন্য নিজের চিন্তা ভাবনা ও উদ্দেশ্য কে কিছু সময়ের জন্য পশে রেখে সময় মত কাউন্টার করে নি। 

সবশেষে বাবার নিজের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা ও মানুষ এর জন্য কাজ ব্যাতিত অন্য কিছু বিষয় নিয়ে একটু না বললে গল্প সম্পূর্ণ হয় না।  বাবা ও মা দুইজনই ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলার পাশাপাশি দুটি গ্রামের মানুষ।  শুনেছি দুরন্তপনার জন্য আমার ঠাকুরদা একটা লোক রেখেছিলো বাবাকে সামলাতে।  বাবার ১৮-২০ টা কুকুর ছিল যা নিয়ে ছিল ঠাকুরদাদার অন্যতম  মাথাব্যাথা।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাবা ও মা দুই জনই লড়েছিল।  কিন্তু হয়ত ঠাকুর দাদা ভেবেছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতে জীবনযাত্রার মান ভাল হবে, যেমন এখন অনেকেই এই একই কারণে ভারত থেকে  ইউরোপ-আমেরিকায় যায়।  সেই জন্যই ঠাকুর দা একপ্রকার জোর করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়।  মা পড়াশোনায় ভাল ছিল এবং বাংলাদেশে একটা চাকরি করত।  বাবার জীবনসঙ্গী হয়ে  চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে আসে।  পরবর্তীতেও বাবার সকল কাজে সাহায্য করে এবং সেটা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল আগেই বলেছি। মা যদি এমন না হত তবে আমার বিশ্বাস বাবার আজ যত টুকু সফলতা সেটাও হতো না বা আমরা ভাইবোনরা আজ  নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি সেটাও সম্ভব হতো না।  যাইহোক  বাড়িতে মাঝে মাঝেই মায়ের সাথে বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেবেলার গল্প করতে শুনেছি। কোন গ্রামের কোথায় কি গাছ ছিল তার ফল কেমন ছিল বা গ্রামের অমুক মানুষটা কেমন ছিল তাদের কি হয়েছে ইত্যাদি।  এসব থেকে বুঝতে পারি ছেলেবেলায় ফেলে আসা গ্রামকে কিভাবে মিস (বাঙালা শব্দ মনে আসছে না ) করে।  বাংলাদেশের গ্রামের থেকে যে কেউ এলে বাড়িতে অন্তত একবার না খেয়ে কেউই ফেরেনি।  এব্যাপারে বাবা ও মা দুইজনই ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।  বাবার কুকুর প্রীতি ছিল আজীবন।  যার জন্য বাড়িতে কখনো একদিনের জন্য কুকুর শুন্য হয়নি।  একসময় ছিল ১৮-২০ টা দেশি কুকুর যা নিয়ে ছিল ঠাকুর দাদার মাথাব্যাথা আর আজও মসলন্দপুর এর গ্রামের বাড়িতে আছে ১১-১২ টা দেশি কুকুর যা প্রতি বছর বাড়ছে।  এদের খাবারের ব্যবস্থা করা যেমন সমস্যার আবার এতো গুলো কুকুর বাড়িতে থাকাও সমস্যার।  এক কালে এই কুকুরের জন্য ঠাকুর দাদা বিরক্ত হয়েছে আর আজ মা ও  প্রতিবেশীরা।  কিন্তু যে মানুষ সারাজীবন সাধারণ দুঃস্থ - পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করে গিয়েছে তার এই মানবতা ও জীবপ্রেম শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে সেটা হয় না।  আজীবন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নাস্তিক মানুষটা হয়ত এভাবেই জীবেপ্রেম করে প্রকৃত ঈশ্বরে সেবা করে গিয়েছে , যে ঈশ্বর মূর্তিতে বা স্বর্গে নয় আছে  আমাদের মধ্যেই আমাদেরই আশেপাশে।

সুমন বিশ্বাস, ছোট ছেলে    


Comments

taniya said…
কতকিছু ভুলে গেছিলাম,খুব ভালো লেখা হয়েছে লেখাটা।আমার খুব ভালো লাগলো।।
Goutamaalee said…
ইতিহাসের মণি মুক্তো।

Popular posts from this blog

Yangthang vally in March, North Sikkim, India

Yangthang in end of March (2008). It’s a place in north sikkim . It’s in 12000 feet.